Author |
I'm Rz Rasel
From Dhaka, Dhaka, Bangladesh
|
|
|
|
|
|
Meghla Aakash |
|
|
Friday, March 2, 2012 |
|
|
আমাদের রইস আলী আমাদের দুলেনারা
জলের স্বভাব হলো মন ভিজিয়ে তোলা। আর সে জলের তরল পাটাতনে যদি নামে শ্রাবণের ধারা, বশীভূত অন্তরও হয়ে পড়ে অস্থির। ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দিতে রুপালি মেঘের কুচি। দলছুট মেঘের ঝরনার নিচে ভিজতে। বিছানো জলে গা ভাসিয়ে সাঁতার কাটতে। হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে নাগরিক যান্ত্রিকতা, ইট-পাথরের ইমারত ডিঙিয়ে, বিষাক্ত ধুলোর আস্তর ছিঁড়েখুঁড়ে মন ছুটে যায় বালিকা দিনে। ধানমন্ডি লেকের পাশে ঝুলন্ত বারান্দায় বসা আমাকে ডাকে আমাদের রইস আলী, আমাদের দুলেনারা। এক গাঁটরি স্মৃতির বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে সওয়ার হতে যাই শৈশবের ট্রেনে। ‘দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায় রইল না’-এর রিংটোন টেনেহিঁচড়ে থামায় আমাকে। ১০ বছরের ছেলে মুহিত আসে—মা, তোমার ফোন। বিরক্ত হয়েও রিসিভ বাটন টিপি, কিন্তু ওপাশের গলা শুনে বিরক্তির ভাঁজ পুটপুট ছিঁড়ে গিয়ে অদম্য কৌতূহল তৈরি করে, লাদেন নিহত হয়েছে। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের বাড়িতে ২ মে গভীর রাতে যুক্তরাষ্ট্রের এক স্পেশাল কমান্ডো অ্যাসাইনমেন্টে নিরস্ত্র লাদেন মারা গেছে।
বারাক ওবামা, আমেরিকা লাদেন আর পাকিস্তানের যোগসাজশে তৈরি হট নিউজের উত্তাপে আমাদের রইস আলী আর দুলেনারা পিছু হটে। ওদের সারল্যমাখা অবয়বগুলো ভোরের শুকতারার মতো মিলিয়ে যায়। আট নম্বর ব্রিজের ওপর দিয়ে চলমান প্রাডো, এলিয়ন আর প্রিমিও গাড়ি ছোটে ৭০ কি ৬০ অথবা ৫০ কিলোমিটার স্পিডে। কোনো কোনো গাড়ির সিডি থেকে দ্রিম দ্রিম মিউজিকের শব্দ আছড়ে পড়ে আমাদের ঝুলবারান্দায়, টাইলসের মসৃণ সাদা রঙে। চুলোয় ভাত। বোরো, আমনখেতের ফসল এখন গ্যাসের চুলোয় টগবগিয়ে ‘ভাত’ হচ্ছে। ঘেমো পিঠে জল্লাদের মতো নামা বেদরদি রোদের তাপ সয়ে ফজলু অথবা ইদ্রিস মিয়ারা কি জানত সে কার জন্য ফসল বুনছে? ঢাকনা উঠিয়ে ভাতের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি। নৃত্যরত সাদা চালগুলো জুঁই হয়ে ফুটে ভাত হলো কিনা দেখার জন্য কাঠের চামচ ডুবাই হাঁড়িতে। এখানেও জল। ঘন সাদাটে। আর রুখে কে! একটা সোমেস্বরী নদী হুড়মুড় করে আট নম্বর ব্রিজ টপকে, ধানমন্ডি লেক উপচে আমার পনেরো শ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে। একটা কাঠের ডিঙায় চড়ে আমাদের রইস আলী আর দুলেনা এসে ভেড়ে বারান্দায়।
আমরা আয়া পড়ছি গো রুবী
তুমি ত আমরারে ভুইল্লাই গেছো...
শৈশবের খেলার সাথিরা অভিমানে গাল, ঠোঁট ফোলায়। দেয়াল ঘড়ি সুরেলা অ্যালার্ম বাজায়—একে একে সাতটা। আঁতকে উঠি। আটটায় অফিস। ছেলেকে স্কুলে নামানো। ডাবলিনে ডোনারদের জরুরি ই-মেইল করা। বললেই হলো—আমরা আয়া পড়ছি...। রইস আলীর দিকে তাকাই—হায় আল্লা, একটা ঢলঢলে হাফপ্যান্ট পরা, স্রেফ উদোম গা, পাভর্তি ধুলো। বিরক্ত হই। বুয়া বলাকওয়া ছাড়া তিন দিন ধরে আসছে না। কত কষ্টে ঘর মোছা। দুলেনার হাতে পুতুলের বাক্স আর কয়টা খেলনা হাঁড়িপাতিল। এত কিছু সামলাতে গিয়ে বুকে ঠেসে ধরেছে জিনিসগুলো। কিন্তু নাক বেয়ে নেমে আসা সর্দি, তা মোছে কীভাবে? আমি চেঁচিয়ে উঠি এসব কি—জলদি নাক সাফ কর দুলেনা। আমার রূঢ়তায় ওর মুখটা ম্লান হয় একটু। ইন্টারকম বেজে ওঠে পাখির স্বরে—এই রে, নিশ্চয় ড্রাইভার রিমাইন্ডার দিচ্ছে বের হতে দেরি হবে কিনা...। স্কুল ড্রেসে ছেলে এসে দাঁড়ায়—মা, আমি রেডি। তুমি তো এখনো চেঞ্জও হওনি। আমার এই ব্যস্ততা টের পেয়ে রইস আলী আর দুলেনারা আবার কিস্তি নৌকায় উঠে বসে। মনমরা মুখে রইস বৈঠা মারে। বারান্দায় চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে দেখি, ওদের নিয়ে নাওটা ক্রমেই দূরে হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলের খাবার টিফিনবক্সে ভরলেও নিজের লাঞ্চ নেওয়ার সময় আর হয় না।
স্টাফ মিটিং। আজকের মিটিং মিনিটস তৈরির দায়িত্ব আমার। একটা পয়েন্টও যাতে মিস না হয়, সে জন্য শিকারি বকের মতো চোখ আর কান পেতে রাখি। আজকের এজেন্ডা ‘বাংলাদেশের শিশু ও নারী পাচার’।
বাংলাদেশে প্রতিবছর শিশু ও নারী পাচার হয় ১৫ হাজার। ১৯৯০-১৯৯৭ সালে প্রায় দুই লাখ নারী ও ছয় হাজার শিশু পাচার হয়েছে। এ তথ্য জানা যায় সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডি মে ১৯৯৮ রিপোর্ট অনুসারে। শিশু ও নারী পাচারের প্রধান রুট হিসেবে বাংলাদেশ ও নেপাল ব্যবহূত হয়ে আসছে।
’৭৯-৮৯ এই ১০ বছরে আনুমানিক দুই লাখ কিশোরী বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রি হয়েছে এবং এই পতিতালয়গুলো পাকিস্তান, ইন্ডিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে। প্রতিদিন বাংলাদেশের স্থল সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ৫০ জন শিশু ও নারী পাচার হচ্ছে।
টি-ব্রেকের জন্য ১৫ মিনিট বরাদ্দ হলে প্যাসিফিক সমুদ্র থেকে সমাহিত লাদেন ফিরে আসে আমাদের চায়ের কাপে। লাদেন হত্যা মিশনের নায়ক বাপের বেটা বারাক ওবামা সে-ও বাদ থাকে না। আসে আসিফ আলী জারদারিও। অ্যাবোটাবাদের সেনা ছাউনির নাকের ডগায় কী করে লাদেন এত দিন বসবাস করে আসছিল? পাকিস্তানের বাঘা ইন্টেলিজেন্ট ব্রাঞ্চ কি ফিডারে দুধ খাচ্ছিল? আর মাঝরাতের সুনসান নীরবতায় লাদেনের বাড়ির কার্নিশে কমান্ডো বাহিনীর প্রথম বিমানটি যখন গোত্তা খেয়ে বিকল হলো, তখনো কি আওয়াজ-টাওয়াজ লাদেনের চৌকস নিরাপত্তাকর্মীদের কানের ফুটোয় ঢোকেনি? লাদেনের মতো ফুলটাইম ফাইটার কীভাবে নিরস্ত্র হাতে ঘুঘুর মতো টপাটপ গুলি খেয়ে মরে যায়। একজন মহিলা সহকর্মীর ফিশ ফিশ মন্তব্য আমার কানের ফুটোয় উপুড় করে দেয়। লাদেন, ওবামা কিংবা জারদারির মতো ইয়া ইয়া ব্যক্তিত্বগুলো গুরুত্ব হারিয়ে আমার মাথায় গিজ গিজ করে মিটিংয়ে পাওয়া ওমেন অ্যান্ড চিলড্রেন ট্রাফিকিংয়ের ভয়াবহ চিত্র।
’৯৭ সালের ‘ট্রাফিকিং ওয়াচ’ সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশের ১০ হাজার শিশু ভারতের মুম্বাই এবং গোয়া পতিতালয়ে আছে। এরা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দিনাজপুর, কক্সবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা দিয়ে মূলত পাচার হচ্ছে। উটের জকি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হওয়া নিরীহ ভাগ্যহীন শিশুদের রক্তশূন্য মুখগুলো আমার চোখের আওতায় ক্রমাগত আর্তনাদ করে ওঠে। সুপারসনিক বিমানের ক্ষিপ্রতা অতিক্রম করে, ধুলোর টর্নেডো তৈরি করা লম্বা গলা কুঁজওয়ালা উটের দৌড়ে ব্যবহূত জকি বাবলু, সুরুজ আলি, কদমদের ভয় পাওয়া বিবশ চিৎকার আসে কানে। অ্যাটেনশন প্লিজ। ধূমায়িত চায়ের কাপ খালি এখন। সমুচা আর বিস্কুটের গুঁড়ো পড়ে থাকা প্লেটগুলোও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আজকের মিটিংয়ে চেয়ারপারসন কান্ট্রিডিরেক্টর ওরলা মার্টিন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। মিটিং শুরু হওয়া মাত্র রাইটিং প্যাডে আমার আঙুল কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। এক্সকিউজ মি—বিরতির এক ফাঁকে সোয়ানা স্টলওয়ার্দি আমার দিকে তাকায়—নিচু স্বরে বলে, আমি আজ রাতের ফ্লাইটে চিটাগাং যাচ্ছি। তুমি কাইন্ডলি মিটিং মিনিটসটা আমার মেইল অ্যাড্রেসে থ্রো করো প্লিজ। একটু থেমে বলে, একচুয়েলি জাস্ট নাউ আ’ম লিভিং দ্য মিটিং। বিকস আ’হেভ অ্যানাদার শিডিউল। ঘড়ির দিকে তাকায় সোয়ান। তারপর নিঃশব্দে ব্যাক ডোরে বেরিয়ে যায়। শুধু যাওয়ার আগে ওরলার সঙ্গে একঝলক দৃষ্টি বিনিময় করে। ওর এই প্রোগ্রাম আগে থেকেই হয়তো সেটআপ করা। মিটিংয়ে আর একটুও টোকা না দিয়ে ও চলে যায়।
পাঁচটায় মিটিং শেষ হলে মাথা ভার ভার লাগে। এখনই এক কাপ কড়া ব্ল্যাক কফি গিলতে হবে। তার আগে একটা ডিসপ্রিন। শুধু ভার ভার নয়, মাথাটা ঢিপঢিপ ব্যথাও করছে। আমিই বা কতটুকু স্বস্তিতে আছি। ঘর গেরস্থালি, সন্তান, যানজটের গেরো খুলে খুলে ধানমন্ডি থেকে উত্তরায় আসা! এর মধ্যে আবার বোকাসোকা ইনোসেন্ট বালিকাবেলার জন্য ‘মন কেমন করে ওঠা’র শৌখিন আহা উহু। খেলার সাথি রইস আলী দুলেনাদের দৌরাত্ম্য!
অফিসের স্টাফ বাসে উঠে বসি। ছেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরে না। খালি বাসায় বেচারা কার কাছে থাকে। স্কুলে ছুটির পর ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে চলে যায় ওদের সোবাহানবাগের বাসায়। মামার বাসা হলেই কী। রোজ রোজের ব্যাপার। আমি তাই মুহিতকে ভালো করে টিফিন দিয়ে দিই, যাতে লাঞ্চও কাভার করে। অফিসের বাস রোজ আমাকে সংসদ ভবনের গোলচত্বরে নামায়। ওখান থেকেই গাড়ি এসে আমাকে পিক করে। বাসের সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসি। হাত-পাগুলো খুলে খুলে যাবে যেন। বড় ক্লান্ত লাগে। তাড়াহুড়োয় লাঞ্চও আনিনি। স্রেফ একটা বার্গার কামড়িয়ে অভ্যেসি খিদেকে বশ করেছি। লাঞ্চে এসব বার্গার-ফার্গার অসহ্য লাগে। একটু সাদা ভাত তার সঙ্গে ডালভর্তা একটা হলেই হলো। তবে ভাতটা চাই। একেবারে ভেতো বাঙালি। শৈশবে হাঁড়িপাতিল খেলার সংসারে রইস আলী হতো আমার বর, দুলেনা কখনো শাশুড়ি, কখনো সতিন। আমার দাদার সে সময়ই চারটা বিয়ে। ঘরে তখনো দুই দাদিই বর্তমান। চাচা, জ্যাঠাদেরও কারও কারও দুই বউ। ‘সতিন’ শব্দটা তাই শৈশবেই পরিচিত আমাদের। তবে সতিন হলেও দুলেনা কখনো ঝগড়াটে পাজি সতিন হতো না। বরং বুবু দেও, তুমারে মরিচটা বাইট্টা দেই, তুমার কোমর বিষ...। আর রইস শয়তানটা জামাই হওয়ার দাপটে ঘরে ফিরেই—কই লো আমার খড়ম কই, আমার ওজুর পানি কই বলে হাতের হ্যালেঞ্চার ডাল দিয়ে সত্যি সত্যি আমাদের দুজনকে মার লাগাত। নারী নির্যাতনের ‘সবক’ তো আমাদের ছেলেরা জন্মের পর তাদের সংসারের ‘পাঠশালা’ থেকেই শিখে বসে থাকে। আমাদের বহন করা স্টাফ বাস বারিধারার যানজটে গেঁথে পড়ে। গার্মেন্টস ছুটি হয়েছে। উঁচু উঁচু ভবন থেকে বানের পানির মতো অগণিত কালো কালো মাথা বেরোচ্ছে। যেন পাহাড়ি ঢল। দেখার মতো দৃশ্য। হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই মনে হয়—এই মানবঢলে কি আমাদের রইস আলী অথবা দুলেনারা আছে? দাদাজান মারা যাওয়ার পর ঈদ পর্বে কিংবা শীত, গ্রীষ্মের বন্ধে গ্রামে যাওয়া ক্রমেই অনিয়মিত হয়ে ওঠে আমাদের। সম্ভবত ম্যাট্রিক পাস করার পর আর যাওয়া হয়নি।
বনানী-কাকলী পার হওয়ার সময় ব্যাগের ভেতর অনেকক্ষণ শান্ত হয়ে থাকা মোবাইলটা দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। রিসিভ বাটন টেপার সঙ্গে সঙ্গেই ইশতিয়াকের গলা—কদ্দুর?
বনানী-কাকলী
মাত্র? আমি আর্লি চলে এসেছি, কিন্তু কপালে বউয়ের হাতের চা নেই।
নিজেই করে নাও না।
দূর, সারা দিন অফিস করে এখন চা বানাব?
মেজাজ খারাপ হলেও বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাই না। বরং বাসের জানালায় চোখ রাখি। যে জানালাটা জাদুকরের মতো একের পর এক দৃশ্য পাল্টাতে চৌকস।
হুড তোলা রিকশায় প্রেমিক-প্রেমিকার সুখী অবয়ব।
শপিংমলে খামাকা ঢুঁ মারতে আসা বিত্তবান মোটাতাজা গৃহিণীদের থলথলে হাঁটা।
বেলুন হাতে ঝলমলে শিশুর গাল উপচানো হাসি।
সংসদ ভবনের গোল চত্বরে বাস থামলে ঝটপট নামি। কিছু দূরেই আমার জন্য অপেক্ষমাণ সিলভার এক্স করোলা দেখে প্রীত হয়ে উঠি—যা হোক এখানে অন্তত অপেক্ষা করতে হবে না।
ইন্টারকমেই ভাবিকে বলি—মুহিতকে পাঠিয়ে দাও। আজ আর উঠব না। খুব ক্লান্ত, সাহেবও বাসায় চলে এসেছে। মুহিত গাড়িতে উঠে খুব খুশি—বাবা আজ তাড়াতাড়ি চলে এসেছে? খুব মজা হবে, বাসায় গিয়ে রেসলিং দেখব।
জনসিনা, বিগ শো, মার্ক হেনরি, সিএম পাঙ্ক যা লড়ে না!
মন খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ভাবি—ছেলেগুলো কি মারামারি ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না? তবু ক্ষোভ অক্ষত রেখে ছেলেকে আদর করি—বাবুসোনাটা মামার বাসায় লক্ষ্মী হয়ে ছিলে তো? মামিকে ডিস্টার্ব করোনি তো?
টিফিন সব খেয়েছ তো? মুহিত পর্যায়ক্রমে উত্তর দিয়ে যায়—হ্যাঁ, না, হ্যাঁ। বাসায় ঢুকে আর কোনো দুষ্টুমিকে প্রশ্রয় দিই না। ভাবিকে বলেছি, ‘সাহেব’ বাসায় এসেছে। সাহেব কথাটার আড়ালের ক্ষোভটা ভাবি বোঝেনি। বাসায় ফিরেই রান্নাঘরে ঢুকতে হবে। বৈকালিক চা-নাশতা বানাতে। তারপর রাতের খাবার তৈরি ছাড়াও সবার জন্য আগামীকালের লাঞ্চ। কখন ছুটি হবে আমার? সংসদ চত্বরে মনোরম বিকেল, সবুজ বৃক্ষরাজিও আজ আমার মেজাজ নমনীয় করতে পারে না। কী জীবন বহন করে চলছি? বিজয় সরণির মোড়ে আবার জ্যামে পড়ি। পপকর্ন নিবেন ভাইয়া? পিয়াল জানালার কাচ নামায়—মা, পপকর্ন কিনে দাও। সারা দিন পর সন্তানের এই আবদার বিরক্তি ঢেলে নষ্ট না করে পার্স খুলে টাকা বের করি। বিক্রেতা আট-নয় বছরের একটা মেয়েশিশু। জিজ্ঞেস করি—কী নাম তোমার? ‘দুলেনা’ মেয়েটার মায়াবী চোখ দুটো হেসে ওঠে। চমকে উঠি আমি। দুর্বল হয়ে ওঠে মন। ওকে আরও পাঁচটি টাকা বাড়িয়ে দিই। টাকাটা হাতে নিতে নিতে প্রশ্রয় পাওয়া উচ্ছ্বাসে দূরে দাঁড়ানো একটা ছেলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে অপ্রাসঙ্গিক বলে—ওই আমার ভাই, রইস আলী। বোকা বোকা মুখ করে এদিকেই তাকিয়ে ছেলেটা। জ্যাম খুলে যেতেই গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। পেছনে পড়ে থাকে আমাদের রইস আলী, আমাদের দুলেনারা। |
|
|
|
|
|
|
|
f |
|
|
Wednesday, February 29, 2012 |
|
|
f |
|
|
|
|
|
|
|
22 |
|
|
Monday, February 27, 2012 |
|
|
eee |
|
|
|
|
|
|
|
Meghla Aakash |
|
|
Thursday, January 5, 2012 |
|
|
ঘড়িতে সময়টা দেখলেন ইমন সাহেব। রাত তিনটা। বিরক্তিভরে সামনের কাগজটা ছুড়ে ফেললেন তিনি। কিছুদিন ধরেই গল্পটা শেষ করতে চাচ্ছেন, পারছেন না। এদিকে সম্পাদকও বারবার তাড়া দিচ্ছে, মাথাটার যে কী হলো, নিজের ক্ষমতা নিয়েই সন্দেহ হচ্ছে। এমন সময় আবার পাশের বাসার পাগল মেয়েটা চিৎকার শুরু করে দিল, এরপর ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না। দিনের বেলায় কিছু মনে হয় না, কিন্তু রাতের নিস্তব্ধতায় এমন চিৎকার শুনে গা হিম হয়ে এল। এই বাসাটাই যত নষ্টের গোড়া, আশপাশে অদ্ভুত সব মানুষ, কেউ মোটেও মিশুক নয়, আবার রাতের বেলা এমন অদ্ভুত চিৎকার। এখানে আসার পর থেকেই লেখাটা জমছে না। বিরক্ত হয়ে ভাবলেন, কালই নতুন বাসার খোঁজে বের হবেন, এমন অদ্ভুতুড়ে জায়গা তার জন্য নয়। মিতাকে ডাকলেন একবার, কোনো সাড়া নেই। রাতের বেলায় লিখলে তিনি বেডরুমের পাশের ঘরটাতেই বসেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে ল্যাম্পটা নেভাতে গিয়েও আবার বসে পড়লেন। আচ্ছা এরপর লাবীবের মৃত্যু আর নোভার পাগল হয়ে যাওয়া—এমনটা হলে কেমন হয়? তাতে শেষটা হবে দুঃখের, আর এমন গল্পই পাঠকের মনে ধরে। দ্রুত বসে পড়লেন তিনি। এক ঘণ্টাও লাগল না শেষ করতে। যাক, শেষটা ভালোই হলো, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। কিন্তু একটু পরই ধড়মড় করে উঠে বসলেন, কে যেন তার পা ধরে নাড়ছে। ব্যাপারটাকে স্বপ্ন হিসেবে ভাবতে চাইলেন, পারলেন না, কারণ তার আগেই একটি মেয়ে কঠিন গলায় বলে উঠল—‘এই যে, তাড়াতাড়ি ওঠেন।’ আশ্চর্য তো! চোর কি? তাহলে এভাবে ডাকবে কেন? নাকি ডাকাত? কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে মাথা যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে বললেন, ‘আপনি কে? এখানে ঢুকলেন কীভাবে?’ ‘আগে বাতি জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি লিখতে বসুন।’ ‘বাব্বাহ, লেখক তিনি, সে খবরও জানে মনে হয়’, মনে মনে বললেন তিনি। মুখে কিছু বললেন না, কারণ মেয়েটার তুলে ধরা হাতে কিছু একটা চকচক করে উঠল। কথামতো উঠে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে চেয়ারে বসলেন তিনি। মেয়েটা পেছনে দাঁড়িয়ে, তবে ফোঁপানোর শব্দ শুনেছেন তিনি। ‘আপনার খাতা খুলে আজ যে অংশটা লিখেছেন তা কাটুন।’ চমকে পেছনে তাকালেন তিনি। মেয়েটা এতসব জানল কী করে? ভয়ংকর অসুস্থ মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। এতক্ষণে প্রচণ্ড ভয় পেলেন আনিস সাহেব। ‘তাড়াতাড়ি কর’—এবার ‘তুই’তে নেমে এসেছে। হাত-পা নড়তে চাইছে না, তবুও অনেক কষ্টে পাতাগুলো ছিঁড়লেন। ‘এবার লিখতে থাক’—মেয়েটা বলে যাচ্ছে, আনিস সাহেব লিখছেন, কী লিখছেন, কেন লিখছেন, খেয়ালই করতে পারছেন না। একসময় মেয়েটার বলা শেষ হলো, কিন্তু আনিস সাহেব নড়তে পারলেন না। পেছন থেকে মেয়েটা বলছে, ‘আমার লাবীবকে একবার মেরেছিস তুই, আবার মারলে তোকেও মরতে হবে। এবার ভালোয় ভালোয় শুয়ে পড়।’ হাত-পা যেন চলছেই না, তবুও দাঁতে দাঁত চেপে কোনোমতে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মেয়েটা তখনো সামনে দাঁড়িয়ে। বাতির আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীল রঙের কাজ করা শাড়ির আঁচল। এটা কিছুতেই কল্পনা হতে পারে না, ভয়ে তিনি ক্লান্তি বোধ করছেন। এভাবেই কখন ঘুম এল জানেন না। সকালে মিতার ডাকে ঘুম ভাঙল। বাতি জ্বালানো দেখেই রাতের সব ঘটনা মনে পড়ল। দৌড়ে গিয়ে দরজা-জানালা সব দেখলেন। ভেতর থেকেই বন্ধ, সারা ঘর চেক করলেন। কেউ নেই। হাঁফ ছাড়লেন তিনি। নিশ্চয়ই রাতে বাতি জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন, সব দুঃস্বপ্ন। মিতাকে ডেকে সব বললেন। ‘রাত জেগে লেখালেখি করেই মাথাটা নষ্ট করলে, আর এ কদিন টেবিলে বোসো না, আমি লেখাটা পাঠিয়ে দেব।’ কিছুদিন পর ম্যাগাজিনটা খুলে বসলেন আনিস সাহেব। সাধারণত তাঁর কোনো লেখা ছাপলে মিতাই আগে পড়ে। কিন্তু এবার তিনি কৌতূহল বোধ করছেন, শেষ অংশটা থেকেই শুরু করলেন। হ্যাঁ, লাবীব হারিয়ে গেল, এরপর... এরপর ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। কারণ লাবীব আবার ফিরে এসেছে, নোভা ভালো হয়ে গিয়েছে, তাদের বিয়েও হয়েছে। কলবেলের শব্দে সংবিৎ ফিরে পেলেন তিনি। একজন মহিলা এসেছেন। ভীষণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে দরজা থেকেই বিদায় নিলেন আবার। মিতা ফিরে এল একটা বিয়ের কার্ড হাতে। ‘জানো এই মহিলার মেয়েটাই পাগল ছিল, নোভা। এখন ভালো হয়ে গিয়েছে। আগামী সপ্তাহে নাকি আবার বিয়েও হবে। কী অবাক কাণ্ড, ভাবো তো!’ |
|
|
|
|
|
|
|
Meghla Aakash |
|
|
|
|
|
টেবিলের ওপর চেয়ার তুলে তার ওপর উঠে দাঁড়াতেই মাকড়সাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। পেট মোটা কুচকুচে কালো একটা মাকড়সা চুপটি করে জালের মধ্যে বসে আছে। আরে, এইটার দেখি দশটা পা। আশ্চর্য! বোধ হয় প্রতিবন্ধী মাকড়সা। পিঠের একদম মাঝখান থেকে দুটি পা বের হয়ে আছে। আজকেই যে প্রথম মাকড়সা দেখছি এমন নয়, বরং মাকড়সার জাল বোনা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাকড়সার জাল বোনা দেখেছি এমন রেকর্ড আমার বহু আছে। এই মুহূর্তে টেবিলে চেয়ার সাজিয়ে মাকড়সা দেখার কারণ হলো, চার দিন আগে একটা ম্যাগাজিনে পড়লাম, আমার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ নাকি মাকড়সাকে খুব ভয় পান। এমনকি একবার কলবেল চাপতে গিয়ে মাকড়সার গায়ে হাত পড়ায় শক খাওয়ার মতো চিৎকার করেছিলেন। এতটুকু পড়ার পর থেকেই মাকড়সা সংগ্রহ শুরু করেছি। যেখানেই মাকড়সা দেখি, সেখান থেকেই ধরে নিয়ে আমার টেবিলের নিচে রেখে দিই। দুদিনেই অনেক মাকড়সা জমা করেছি। কোনো কোনোটা ভারি সুন্দর, আবার কোনো কোনোটা দেখলে বমি আসে। আমার ঘর মাকড়সার জাল দিয়ে ভরে গেল। গতকালও এই প্রতিবন্ধী মাকড়সাটি ক্লাসরুমে ছিল না। আজ কোত্থেকে এল কে জানে। মাকড়সাটা ধরতে একটু কষ্টই হলো। বাসায় এসে টেবিলের নিচে ছেড়ে দিলাম। রাতে জানালা বন্ধ করছি, তখন শুনলাম আব্বু আম্মুকে বলছেন, ‘কী ব্যাপার, মাকড়সার জাল দিয়ে তো ঘর ভরে যাচ্ছে, পরিষ্কার করো না কেন?’ আম্মু বললেন, ‘গতকালও পরিষ্কার করেছি, আজকে আবার ঘর ভরে ফেলেছে। কী করি!’ রাতে ঘুমানোর আগে ভাবলাম, মাকড়সাগুলোকে একবার দেখে ঘুমাই। লাইট বন্ধ করে টেবিলের নিচে টর্চের আলো ফেলতেই অবাক হয়ে গেলাম। প্রতিবন্ধী মাকড়সাটা ছাড়া আর কোনো মাকড়সাই নেই। এমনকি মাকড়সার একটা জাল পর্যন্ত নেই। পিঁপড়াদের জন্য এক কোনায় চানাচুর খানিকটা ছড়িয়ে রেখেছিলাম। যেমন চানাচুর তেমন আছে, একটা পিঁপড়া পর্যন্ত আশপাশে নেই। উফ্! আজকে যে আমার ঘরে একটা মশাও নেই! প্রজাপতিটাই বা কই গেল? এবার সত্যিই ভড়কে গেলাম। ভয়ে ভয়ে কালো মাকড়সাটার গায়ে টর্চের আলো ফেললাম। মাকড়সাটাকে আগের চেয়ে একটু মোটা মনে হলো। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেলাম, তাড়াতাড়ি এসেই শুয়ে পড়লাম। আন্দাজ, মাঝরাত হবে। দেখি ঘরের সব আসবাব উড়ে উড়ে আমার গায়ে এসে পড়ছে। তখনি আমার ঘুমটা ভাঙল। ঘেমে ভিজেটিজে একাকার। প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা। বাথরুমের দরজাটা খোলা, ভেন্টিলেটর দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো মশারি ভেদ করে বালিশের ওপর পড়ছে। ঝকঝকে চাঁদের আলো। আগে থেকেই চাঁদের আলো বড় ভয় পাই আমি। পানি খেতে উঠব কি উঠব না ভাবছি, ভয় করছে একটু একটু। স্বপ্নের ধকল তখনো কাটেনি, এমন সময় চাঁদের আলোটুকু মুছে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। ভয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। বালিশের কাছে একটু খুঁজতেই টর্চটা পেয়ে গেলাম। টর্চ জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। যেখানে চাঁদের আলো ছিল, সেখানে কালো মাকড়সাটা বসে আছে। ভয়ে চিৎকার দিতে যাব, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হয় না। মুহূর্তে সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। হাত গলে টর্চ পড়ে গেল। মাকড়সাটা খুব ধীরে ধীরে মশারি ভেদ করে আমার হাতে এসে বসল। আশ্চর্য, মশারিটা একটু ছিঁড়লও না। আমার সব অনুভূতি সজাগ, কিন্তু শরীর অসাড়। একটুও নড়াচড়া করতে পারছি না কোনো অদ্ভুত কারণে। কালো মাকড়সা আমার গায়ে উঠতে লাগল। আমার ইন্দ্রিয় সজাগ, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। আমি মরে যাচ্ছি না কেন? আস্তে আস্তে মাকড়সাটা বড় থেকে বড় হচ্ছে আর আমার অনুভূতি আস্তে আস্তে লোপ পেতে পেতে একসময় সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। সবকিছু ঝাপসা। চোখ মেলতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। কে যেন কাকে বলছে, ‘আহ্, কাঁদবেন না, এখনই জ্ঞান ফিরবে, দেখবেন। দুই ব্যাগ রক্ত দিতে হইছে। গায়ে এক ফোঁটা রক্ত ছিল না। বেঁচে আছে, শুকরিয়া করেন।’ বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, ‘আহ্, রিজিয়া, কেঁদো না তো! দোয়া-দরুদ পড়ো। তিন দিন পর এখন জ্ঞান ফিরে তোমাকে কাঁদতে দেখলে ভড়কে যেতে পারে।’ এবার মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘রুমার হঠাৎ রক্তশূন্যতা হবে কেন? ওর মুখটা কেমন কাগজের মতো সাদা হয়েছিল।’ বাবা ধমকে ওঠেন। কালো মাকড়সার কথা মনে পড়ে গেল। চট করে হুমায়ূন আহমেদের কথাও মনে পড়ে গেল। তিনি কি এ কারণেই মাকড়সাকে ভয় পান? আবার চোখ মেলতে চেষ্টা করলাম। ঝাপসাভাব কাটেনি। মায়ের কান্না কেমন গানের মতো শোনা যাচ্ছে। |
|
|
|
|
|
|
|
Meghla Aakash |
|
|
Wednesday, January 4, 2012 |
|
|
ভাপসা গরমে ঘুম ভাঙল জাফর সাহেবের। পিটপিট করে চারদিকে তাকিয়ে ভয় পেলেন, আবার অবাকও হলেন। কিছুক্ষণ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেন জাফর সাহেব, তিনি কি মারা গেছেন? একটু আগে কোথায় ছিলেন তিনি? হ্যাঁ মনে পড়েছে, বিকেলে অফিস থেকে ফিরে তিনি সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন। তারপর? তারপর আর কিছু মনে নেই। দিনটা শুরুই হয়েছিল একটু অন্যভাবে। নাশতা খেতে খেতে সিমিন বলল — ‘আজকে সব সাদা জিনিস ধোবো...সাদা কিছু থাকলে দাও।’ ‘যা ছিল ওয়াশিং মেশিনে দিয়েছি। সাদা একটা মন ছাড়া আর কিছুই নেই।
আজ নাটকঃ- গরমে ঘুম ভাঙল জাফর সাহেবের। পিটপিট করে চারদিকে তাকিয়ে ভয় পেলেন, আবার অবাকও হলেন। একটু পর নিজেকে আবিষ্কার করলেন একটা বক্সের ভেতর, বলা যেতে পারে কফিন! কফিনের চিন্তা মাথায় আসার পর খুবই ভড়কে গেলেন জাফর সাহেব। অনেক চেষ্টা করেও কফিনের ডালাটা খুলতে পারলেন না। এর পর স্ত্রীর নাম ধরে চিৎকার করলেন, ‘রেহানা! রেহানা!’ আবার ছেলে আবিরের নাম ধরেও ডাকলেন অনেকক্ষণ। এমনিতে কখনো ছেলের সঙ্গে শখ করে কোনো সময় কথা বলেন না, আজ কেন ডাকছেন বুঝতে পারলেন না। ভয়ে বোধহয়। কিছুক্ষণ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেন জাফর সাহেব, তিনি কি মারা গেছেন? একটু আগে কোথায় ছিলেন তিনি? হ্যাঁ মনে পড়েছে, বিকেলে অফিস থেকে ফিরে তিনি সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন। তারপর? তারপর আর কিছু মনে নেই। জাফর সাহেবের মনে হলো, তিনি বেঁচে আছেন। কিন্তু এখানে কী করে এলেন? তাঁর মাথা বিগড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ কিছু একটা শুনতে পেলেন তিনি। আশা জেগে উঠল মনে। জিজ্ঞেস করলেন, —কে কে? তোমার সঙ্গে কথা বলা পৃথিবীর শেষ মানুষ। —কী? কী বলছেন এসব? আমি কোথায়? আপনি কে? এখনো পৃথিবীতেই আছো, তবে আর ১৫ মিনিট পরে থাকবে না। —কী বলছেন এসব? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি ভাই? ভাই, যত টাকা চান তত টাকাই দেব, আমাকে ছেড়ে দিন। তোমাকে তো টাকার জন্য ধরে আনিনি, এনেছি পরের জীবন দেখানোর জন্য, মানে ‘আফটার লাইফ’। তুমি এতগুলো মানুষ মারলে, তোমার সাজা হওয়া দরকার। —কী? আমি মানুষ মেরেছি? কে বলেছে আপনাকে? গতকাল কেরানি লতিফের চাকরি বিনা দোষে বিনা বেতনে নট করে দিয়েছিলে না? —কিন্তু আমি তো তাকে মারিনি। শুধু ছাঁটাই করেছি...। তুমি জানতে তার গরিব ঘরে ছয়জন সদস্য, তারা এমনিতেই না খেয়ে থাকে; এখন তারা কীভাবে থাকবে? এবার বল, তুমি ওদের মার নি? —তখন আমার মাথা ঠিক ছিল না। রাগের মাথায় এ কাজ করেছি। তোমার কফিনের চার কোনায় চারটা পানির নল আছে, পানি ছেড়ে দিলে চার মিনিটেই তোমার কফিনটা পানিতে ভরে যাবে। এখন বল, আমি কি রাগের মাথায় পানি ছাড়ব? —ভাই, আর মাথা গরম করব না, কসম করছি, আমার ছেলের কসম...। মাথা গরম করার টাইমও পাবে না, আর পাঁচ মিনিট। আর ছেলের দোহাই? স্ত্রী আর ছেলের সঙ্গে কয় দিন ভালোভাবে কথা বলেছ, নাকি গত ২০ বছরও তোমার মাথা গরম ছিল? ছোটবেলার বন্ধু আশরাফ খানকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে যে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছ, সেটাও কি অস্বীকার করবে? —আমার ভুল হয়ে গেছে। ভুল স্বীকার করে লাভ নেই। তোমার ভুলের জন্য আশরাফ এখন হাসপাতালে, তাঁর স্ত্রী সাধারণ হাসপাতালের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন, মেয়ের লেখাপড়া বন্ধের দিকে—শুধু তোমার লোভের জন্য। জাফর সাহেব টের পেলেন, আস্তে আস্তে তাঁর কফিনটা ভর্তি হয়ে যাচ্ছে পানিতে! লোনা পানিতে। চিৎকার করছেন তিনি। কাঁদছেন শিশুর মতো, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে...। চোখ খুললেন জাফর সাহেব। আরে! তিনি তো তাঁর বাসায়! সোফায় বসে টিভি দেখছিলেন বোধহয়, কিন্তু একটু আগে এসব কী হচ্ছিল? এটা কি স্বপ্ন ছিল? স্বপ্ন কি এত বাস্তব হয়? হঠাৎ চিৎকার জুড়ে দিলেন জাফর সাহেব। ভয়ানক চিৎকার করছেন তিনি। চিৎকার শুনে তাঁর স্ত্রী রেহানা আর ১৮ বছরের ছেলে আবির ছুটে এল। এতক্ষণ কী হচ্ছিল সেটা নিয়ে রাগারাগি করলেন অনেকক্ষণ, তারপর কি মনে করে হঠাৎ চুপ করে গেলেন। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা খুলে বললেন। তারা দুজনই ব্যাপারটা দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিল। অনেক করেও জাফর সাহেব বোঝাতে পারলেন না যে স্বপ্নটা অনেক বাস্তব ছিল। আবির বলল, বাবা, স্বপ্ন স্বপ্নই, বড়জোর হ্যালুসিনেশন। কিছুক্ষণের জন্য কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন জাফর সাহেব। তারপর ছেলেকে কাছে ডেকে নিয়ে খোঁজখবর জিজ্ঞেস করলেন। নরম গলায় রেহানাকে টেলিফোনটা আনতে বললেন। ফোন করে তিনি কেরানি লতিফকে বেশি বেতনে আবার যোগদান করতে বললেন, আর আশরাফ সাহেবের স্ত্রীকে ভুল স্বীকার করে সব টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বললেন। বন্ধুর এই অবস্থার জন্য নিজেকেও দায়ী করলেন তিনি। আনন্দিত গলায় স্ত্রী রেহানা এসে বলল, দুঃস্বপ্নটা দেখে ভালোই হয়েছে বোধহয়। ভাবলেশহীনভাবে আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকালেন জাফর সাহেব। বাবার রুম থেকে বের হয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ির নিচে নামতে নামতে এন-৮ ফোনসেটটা হাতে নিল আবির। ফোন করল নাজেরকে। ‘দোস্ত, তোর কফিন, পানির পাইপ আর মাইক্রোফোনটা পাঠিয়ে দিয়েছি, আমার কাজ শেষ।’ আবার ফোনসেটে চোখ বুলাল আবির। হঠাৎ নিজের সেটটার দিকে তাকিয়ে মনটা খুশিতে ভরে উঠল তাঁর। |
|
|
|
|
|
|
|
Meghla Aakash |
|
|
Wednesday, December 7, 2011 |
|
|
শ্রাবণের আকাশে বিশ্বাস নেই। বৃষ্টি নামে যখন-তখন। ঢাল ধরে কাশেমপুরে পৌঁছাতে দিনটা হেলে পড়ে। কাঁচা সড়কপথে হাটখোলার মানুষচলা পথেই আবার নদীতে উঠে আসা। দপদপিয়া পেরোলেই তো জলঢাকা। লতাবেড়ি দিয়ে প্যাঁচানো বিলপাড়ে ঘরগুলো সব উঁচু। পাড়ে নোঙর বাঁধা। মলিনাহাটের মানুষ বলে, এখানে রাজার বাড়ি ছিল। বসত জায়গাটা আর নেই। জমিজমা, ঘাটপাট, রাজাপ্রজা, জলমাটি, নৌকা ভেড়ানো নদীপাড়। শ্রাবণ-ভাদ্রে জল না পাওয়ায় পলি পড়ে বাকেরগঞ্জ ফরিদপুর হয়েছে, আর ওদিকে আড়িয়াল খাঁ হয়েছে শায়েস্তাবাজার। বৃষ্টিতে বানের জলে সেসব তো শুধু অন্ধকার ঘন স্যাঁতসেঁতে চলতা পড়া বলেশ্বরের স্থলভূমি। অববাহিকার খাঁড়িতে, বাবুবাজার ঘাটে রাহেলারা, চন্দনারা বসে আছে লঞ্চের গলুইয়ের ডগায়। চন্দনারা প্রতীক্ষা করছে আর ভিড়টা কোন দিকে গড়াচ্ছে তা দেখছে। কাল রাত থেকে যাত্রীরা এখানে আসছে। পরেশ, আলী মিঞা, জান্নার বাপের প্রতিদিনের আসা-যাওয়া। এই তল্লাটে ব্যস্ত নিবারণ চরণ, বলাইরা ডাঙা আর জলের কর্মকাণ্ড দেখে। ঘটিবাটি বিক্রি করে দিয়েছে শানুরা। রাহেলারা বলে, এখানে তারা বিচ্ছিন্ন। সমাজ নেই। জলঢাকায়, মলিনাহাটে চন্দনাদেরও সমাজ ছিল। মলিনাহাটে কাঁটামনসার, ময়নাকাঁটার বেড়া দিয়ে ঘেরা উনুন ছিল। বাষ্প ছিল। সেই ফুটন্ত ভাতের গন্ধটা স্টিমারঘাট পর্যন্ত বাতাসে ভাসে। |
|
|
|
|
|
|
|
|
Problem In Font |
Download then zip file unzip and install in your system. Or normal font file just install in your system font folder. Rz Rasel |
Bangla Font |
Bangla Font |
|
|
|
|