টেবিলের ওপর চেয়ার তুলে তার ওপর উঠে দাঁড়াতেই মাকড়সাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। পেট মোটা কুচকুচে কালো একটা মাকড়সা চুপটি করে জালের মধ্যে বসে আছে। আরে, এইটার দেখি দশটা পা। আশ্চর্য! বোধ হয় প্রতিবন্ধী মাকড়সা। পিঠের একদম মাঝখান থেকে দুটি পা বের হয়ে আছে। আজকেই যে প্রথম মাকড়সা দেখছি এমন নয়, বরং মাকড়সার জাল বোনা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাকড়সার জাল বোনা দেখেছি এমন রেকর্ড আমার বহু আছে। এই মুহূর্তে টেবিলে চেয়ার সাজিয়ে মাকড়সা দেখার কারণ হলো, চার দিন আগে একটা ম্যাগাজিনে পড়লাম, আমার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ নাকি মাকড়সাকে খুব ভয় পান। এমনকি একবার কলবেল চাপতে গিয়ে মাকড়সার গায়ে হাত পড়ায় শক খাওয়ার মতো চিৎকার করেছিলেন। এতটুকু পড়ার পর থেকেই মাকড়সা সংগ্রহ শুরু করেছি। যেখানেই মাকড়সা দেখি, সেখান থেকেই ধরে নিয়ে আমার টেবিলের নিচে রেখে দিই। দুদিনেই অনেক মাকড়সা জমা করেছি। কোনো কোনোটা ভারি সুন্দর, আবার কোনো কোনোটা দেখলে বমি আসে। আমার ঘর মাকড়সার জাল দিয়ে ভরে গেল। গতকালও এই প্রতিবন্ধী মাকড়সাটি ক্লাসরুমে ছিল না। আজ কোত্থেকে এল কে জানে। মাকড়সাটা ধরতে একটু কষ্টই হলো। বাসায় এসে টেবিলের নিচে ছেড়ে দিলাম। রাতে জানালা বন্ধ করছি, তখন শুনলাম আব্বু আম্মুকে বলছেন, ‘কী ব্যাপার, মাকড়সার জাল দিয়ে তো ঘর ভরে যাচ্ছে, পরিষ্কার করো না কেন?’ আম্মু বললেন, ‘গতকালও পরিষ্কার করেছি, আজকে আবার ঘর ভরে ফেলেছে। কী করি!’ রাতে ঘুমানোর আগে ভাবলাম, মাকড়সাগুলোকে একবার দেখে ঘুমাই। লাইট বন্ধ করে টেবিলের নিচে টর্চের আলো ফেলতেই অবাক হয়ে গেলাম। প্রতিবন্ধী মাকড়সাটা ছাড়া আর কোনো মাকড়সাই নেই। এমনকি মাকড়সার একটা জাল পর্যন্ত নেই। পিঁপড়াদের জন্য এক কোনায় চানাচুর খানিকটা ছড়িয়ে রেখেছিলাম। যেমন চানাচুর তেমন আছে, একটা পিঁপড়া পর্যন্ত আশপাশে নেই। উফ্! আজকে যে আমার ঘরে একটা মশাও নেই! প্রজাপতিটাই বা কই গেল? এবার সত্যিই ভড়কে গেলাম। ভয়ে ভয়ে কালো মাকড়সাটার গায়ে টর্চের আলো ফেললাম। মাকড়সাটাকে আগের চেয়ে একটু মোটা মনে হলো। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেলাম, তাড়াতাড়ি এসেই শুয়ে পড়লাম। আন্দাজ, মাঝরাত হবে। দেখি ঘরের সব আসবাব উড়ে উড়ে আমার গায়ে এসে পড়ছে। তখনি আমার ঘুমটা ভাঙল। ঘেমে ভিজেটিজে একাকার। প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা। বাথরুমের দরজাটা খোলা, ভেন্টিলেটর দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো মশারি ভেদ করে বালিশের ওপর পড়ছে। ঝকঝকে চাঁদের আলো। আগে থেকেই চাঁদের আলো বড় ভয় পাই আমি। পানি খেতে উঠব কি উঠব না ভাবছি, ভয় করছে একটু একটু। স্বপ্নের ধকল তখনো কাটেনি, এমন সময় চাঁদের আলোটুকু মুছে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। ভয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। বালিশের কাছে একটু খুঁজতেই টর্চটা পেয়ে গেলাম। টর্চ জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। যেখানে চাঁদের আলো ছিল, সেখানে কালো মাকড়সাটা বসে আছে। ভয়ে চিৎকার দিতে যাব, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হয় না। মুহূর্তে সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। হাত গলে টর্চ পড়ে গেল। মাকড়সাটা খুব ধীরে ধীরে মশারি ভেদ করে আমার হাতে এসে বসল। আশ্চর্য, মশারিটা একটু ছিঁড়লও না। আমার সব অনুভূতি সজাগ, কিন্তু শরীর অসাড়। একটুও নড়াচড়া করতে পারছি না কোনো অদ্ভুত কারণে। কালো মাকড়সা আমার গায়ে উঠতে লাগল। আমার ইন্দ্রিয় সজাগ, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। আমি মরে যাচ্ছি না কেন? আস্তে আস্তে মাকড়সাটা বড় থেকে বড় হচ্ছে আর আমার অনুভূতি আস্তে আস্তে লোপ পেতে পেতে একসময় সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। সবকিছু ঝাপসা। চোখ মেলতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। কে যেন কাকে বলছে, ‘আহ্, কাঁদবেন না, এখনই জ্ঞান ফিরবে, দেখবেন। দুই ব্যাগ রক্ত দিতে হইছে। গায়ে এক ফোঁটা রক্ত ছিল না। বেঁচে আছে, শুকরিয়া করেন।’ বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, ‘আহ্, রিজিয়া, কেঁদো না তো! দোয়া-দরুদ পড়ো। তিন দিন পর এখন জ্ঞান ফিরে তোমাকে কাঁদতে দেখলে ভড়কে যেতে পারে।’ এবার মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘রুমার হঠাৎ রক্তশূন্যতা হবে কেন? ওর মুখটা কেমন কাগজের মতো সাদা হয়েছিল।’ বাবা ধমকে ওঠেন। কালো মাকড়সার কথা মনে পড়ে গেল। চট করে হুমায়ূন আহমেদের কথাও মনে পড়ে গেল। তিনি কি এ কারণেই মাকড়সাকে ভয় পান? আবার চোখ মেলতে চেষ্টা করলাম। ঝাপসাভাব কাটেনি। মায়ের কান্না কেমন গানের মতো শোনা যাচ্ছে। |
Post a Comment